বাঙালি কবি, জার্মান শিল্পী

 


আমি কবিতা বুঝি না৷ না মানে, একদমই না৷ এর মাঝেও যে ক’জন কবি আমাকে কবিতা পড়তে বাধ্য করে তাদের একজন আবুল হাসান। বেশ ছোটোবেলায় বেশিরভাগ বাঙালি পাঠকের মতো আমারও আগাগোড়া না বুঝেই ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’ বা ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ পড়বার মধ্য দিয়ে আবুল হাসানে মুগ্ধ হওয়া। এরপর তো চলছেই… সে যাকগে!

১৯৭৪ সালের দিকে রাষ্ট্রীয় তদবিরে হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসা নেবার জন্যে আবুল হাসানকে পাঠানো হয় পূর্ব জার্মানির এক শহরে। শারিটে হাসপাতাল। অজানা দেশ, অপরিচিত মানুষসব। এরমাঝে জার্মানটাও জানা নেই। যোগাযোগ থেকে শুরু করে ওখানকার পরিবেশে মানিয়ে নেয়া—সবকিছুতেই জটিলতা। সে কঠিন সময়ে কবির সাথে পরিচয় হয় জার্মান শিল্পী রাইনহার্ট হেভিকের। বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত। তৈরি হলো সংখ্যতা। হেভিকে’র বাবা-মা থেকেও পেতে লাগলেন পিতৃস্নেহ, মাতৃস্নেহ। এরমাঝে হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, ‘এখন আর কিছুই করবার নেই। অন্য কোথাও নিলেও কোনোরকম আশা নেই।’ হাসপাতালে এক জানলাবিহীন ঘরে রাখা হলো কবিকে। বাইরের থাকার অনুমতিও নেই হাসপাতাল থেকে। তখন সেখান থেকে একপ্রকার চুরি করেই আবুল হাসানকে নিজের বাড়িতে এনে তুললেন বন্ধু রাইনহার্ট হেভিকে। রাইনহার্টের বাড়ির সবাই শিল্পের সাথে জড়িত। সেজন্যেই হয়তো বাবা-মা থেকে শুরু বাকি সবাই কবিকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে ভুল করেননি! বন্ধু তো আছেনই, সেইসাথে বন্ধুর বাবা-মা থেকে পেতে থাকেন সন্তানতূল্য স্নেহ। যত্ন। তাদের আড্ডা হতো কবিতা-শিল্প নিয়ে। কথা হতো কবির বেড়ে উঠা, তাঁর দেশ, জীবনের গল্প নিয়ে। যৌথভাবে রাত জেগে রচনা করতেন কবিতা। আরো কতো বিচ্ছিন্ন মন কেমনের আখ্যান! এক সময় ওখানে অবস্থান করার মেয়াদ ফুরিয়ে আসে। দূরদেশে পাওয়া বন্ধু, পিতৃমাতৃতুল্য স্নেহের মায়া ছেড়ে পর্বত সমান বিষন্নতা নিয়ে কবি স্বদেশে ফেরবার পথ ধরেন৷

‘বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী’ প্রকাশনাটি রাইনহার্টের লেখা সেসময়কার আবেগময় স্মৃতিকথা এবং কবির সাথে রাইনহার্টের আদান-প্রদানকৃত চিঠির সংকলন। বার্লিন থেকে ফেরবার পর ১৯৭৫ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন কবি। কিন্তু আজীবনের জন্যে রয়ে গেলেন বার্লিনের সেই বন্ধুর মনে। তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে ধরেছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। মৃত্যুর আগপর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন কবিবন্ধুর কবিতাগুলো জার্মানে প্রকাশ করার। অনেকবার উদ্যোগ নিলে অনেকে কথা দিলেও কেউই কথা রাখেনি শেষমেশ। শেষ আশা হিসেবে বন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখে প্রকাশ করবার উদ্যোগ নেন। তাও বাস্তবায়ন হয়েছে অনেক সময় পর। যখন তিনি পৃথিবীর ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

.

বইটা শেষ করেছি মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে। মাঝে আবার মনে হচ্ছিলো মনটন বিষন্ন হয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে! এমনিতেই চিঠি পড়া নিয়ে আমার বিশেষ ঝোঁক রয়েছে। তার ওপর হয় যদি এরকম সারকামস্ট্যান্স নিয়ে! চিঠিগুলো লেখা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন টানাপোড়নকে আবর্তন করে। পড়তে পড়তে একেক সময় উদ্রেক ঘটেছে একেক রকম অনুভূতির। ওসব কিছু বাদ দিলেও পুরো ব্যপারটা আমার কাছে রোমাঞ্চকর। অনুবাদও বেশ ঝরঝরে।

মন্তব্যসমূহ