নাই হয়ে যাবার অদৃশ্য গল্প, কিংবা পৌনঃপুনিকতায় জাতিস্মরের অস্তিত্বের রূপকথা
জীবনকে ওরা ডিফাইন করতো শরতের হবো হবো মন কেমনের নীলাভ সন্ধ্যায় মাটির সোঁদা গন্ধের মায়ায় মৃদু হিম বাতাসে ঢলতে ঢলতে কিংবা হাওয়ার ভরে শেষ বিকেলের ঝাপ বৃষ্টিতে জুবুথুবু কমলা রঙের হাওয়াইন শার্ট গায়ে খোকনের ঘরে ফেরবার পথে বামুন বাড়ির সামনে তুলসী-তলায় হুইসেলের মতো সাঁই করে বেজে ওঠা শঙ্খকাব্যের ধ্বনিত নীরবতার সাথে। তারপর ইলিউশনাল কাল-রাত্তিরের আরেক ঝাপটা মেঘ শেষে তাঁরা স্বর্গ-বেতার মাফিক মর্ত্যেলোকের কবিদের শব্দে প্রচার করতে শুরু করলো নতুন ন্যারেটিভ, জীবনের আসল অলীকতা আসলে নিহিত আছে নৈরাশ্যবাদে।
নক্ষত্রের ইশারা ভাঙবার পর, তারপর কোথাও কিচ্ছুনা থেকে কোত্থেকে কী যে হলো, অসুখে ডুবে গেল সমস্ত পৃথিবী। কোথাও কোনো দিশা নাই। অরুন্ধতির নক্ষত্রের ছায়াও আজ ম্লান। চারপাশ ঘিরে থাকে ছায়াচ্ছন্ন বিভ্রান্তি। নেই কোনো সুরের নির্ভরতা। নেই কোনো ছন্দময় পথচলা। চারপাশে শুধুই অস্পষ্টতার ঘূর্ণাবর্ত প্রতীক। যেন, অদৃশ্য হেমলক মিশ্রিত বাতাসের ন্যায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে হতাশা, অবসাদ, কিংবা বিভ্রান্তির যত্তসব ক্লিশে অউপাদান। নিজের দিকে তাকালে দেখতে শুরু পাই নাই হয়ে যাওয়া স্বপ্নের দেশের পরিত্যক্ত মানচিত্রের বিষন্ন-বিজরিত প্রতিচ্ছবি। সাথে যোগ দেয় চেতনাহীন আয়নায় অস্তিত্বহীন প্রতিবিম্ব দেখবার খোয়াব।
খেয়ালে আসে তাঁর কথা। অঙ্গীকার করেছিলাম ইউটোপিয়ার রেলে চড়ে নাই হয়ে যাবো জনহীন অরণ্যে, একসাথে বেথোভেনের সমস্ত কম্পোজিশনের পিন্ডি চটকিয়ে আর দুটো বোদলেয়ারের পদ্য পড়ে রিপভ্যেনের ঘুমে কাটিয়ে দেবো সহস্রাধিক বছর। চাঁদঘড়ি ঘুরে সেদিন যখন চাঁদের মাঝখানটায়, নাগোরকোটের রেস্ট হাউজে, শুণ্য ডিগ্রি সমেত আমরা ছিলাম সময় ঘড়ির হিসেবে সেকেন্ড এক দূরে, কোত্থেকে কিচ্ছু না থেকে মাথা গোঁজবার আকাশ-সম তাগিদ হারিয়ে দূরত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো এক এক আলোকবর্ষ প্রতিম। তারপর, সেদিন যখন নভেম্বারের শেষ সোমবার, সবকিছু লন্ডবন্ড করে দেবার খোয়াব সমেত আকাশ হাজির হলো ঝড়ের আভাস নিয়ে, হারিয়ে ফেললাম যা ছিলো না থাকা সব। সাদারাতের মায়ায় নাই হয়ে গেলো আমার অরু।
সমস্তরাত শিশির ভিজে আধভাঙা পরিত্যক্ত গির্জার আইভীলতায় মোড়ানো ফটকের ওখানটা থেকে বছরের প্রথম শিউলি কুড়াতে গিয়ে প্রথম ঠাহর করতে পারি ব্যপারটা। ও-কে রেখে এসেছিলাম নীপবনের মাঝ দিয়ে ভাঙা ভাঙা পিচের পথটা ধরে গেলে, অরুর পছন্দের নেমপ্লেটধুসারিত ব্রান্ডির যে দোকানটা, উপর তলায় চার কামড়ার একটা ছোট্টো মোটেল মতো, পাশ দিয়ে বয়ে চলা ও-র ফরাসি রঙশিল্পীর কল্পনায় পাথর ভরা নদীটার অ্যাসেজে। শেষমেশ, চাঁনপসরে হিমবাহের রাত্তিরে, চা বাগানের মধ্যিখানে, নাই হয়ে যাওয়া হিজলতলায় জিরিয়ে নেবার ভ্রমে ম্যাটেরিয়েলেস্টিক আমায় ডিলিউশনাল সিদ্ধার্থের বিরক্তিকর সব মহানির্বাণের গল্পে বুঁদ রাখা অরুও ধরেছিলো নিঃসঙ্গ নির্বাণের সাঁতার।
এ দিনগুলোতে কী যেনো হয়ে যায় আমার। নিজেকেই নিজে চিনতে পারি না। থেকে থেকে গায়েবি কিছু শব্দের আবির্ভাব ঘটে। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। দার্শনিক প্রশ্নের জন্মদাতাদের মতো চিৎকার করতে ইচ্ছে করে, কে আমি? কোথায় আমার শেকড়?
কোথাও কিচ্ছু না থেকে কোত্থেকে এমনই এক মন কেমনের দিনে মনে পড়ে বছর সাতেক আগের কচ্ছপ বন্ধুর কথা। সুন্দরবনের ঘ্রাণমাখা স্মৃতির ফ্রেম থেকে বেরিয়ে আসে ওর ছোট্ট মুখ। ওর এবার বয়স কত হলো? ও কি এখনো বেঁচে আছে? ওর মাঝে খুঁজে পাই নিরোর বাঁশিবীণার তরঙ্গে পুড়ে যাওয়া এলেকজ্যান্দ্রিয়ায় সহস্রাধিক বছর ধরে লুকিয়ে রাখা পুরনো সত্তা। প্রশ্নবিদ্ধ করে যায় অবিরাম, ভিন্ন ব্যঞ্জনায়। থেকে থেকে ছুড়ে দেয় অদৃশ্য, অবহাসিত, উত্তর চায় না যত্তোসব প্রশ্ন।
বিচ্ছিন্ন হতে হতে নাই হয়েছে যে দ্বীপ, তাঁর ভ্রমে করোটির ভেতরে খেলা করে হাজারো অব্যক্ত অসংলগ্ন টুকরো ছবি। বোধ হয়, আমার অস্তিত্ব কোনো বৃহৎ দিগন্তে হারিয়ে গেছে। আমি কি এই পৃথিবীর কেউ? কিংবা হতেও পারি কৃষ্ণগহ্বরের মায়ায় নাই হওয়া অচীন দেশের ভ্রান্ত পথিক? ভ্রম হয়। পল সার্ত্রের বারণ করা পথ ধরে অস্তিত্ব সঙ্কটে ডুবে যাই। এ পৃথিবী আমার নয়। এখানে নেই কোনো আশ্রয়। তারচে বরং আকর্ষণ করছে, টানছে আমায় মহাশূন্যের অন্তহীন নৈঃশব্দ। টের পাই অবশ করে দেয়া নৈরাশার শূন্যতায় নিরাকার শূন্যে বিলীন হয়ে যাবার জন্যে এক অগভীর টান।
মায়ের হাতের যে খাবারটার স্বাদ নেবার জন্য মুহূর্তেই উড়ে যেতাম মাইল পঞ্চাশেক, সে খাবারটাও আজ পাশের টেবিলে অবহেলায় ফেলে রাখতে দ্বিধা করি না। স্বপ্ন দেখতে শেখানো পরিচালকও যেন হারিয়েছেন জাদুরকাঠি। প্রিমিয়ারের প্রথম শো; যে শো নিয়ে বিগত মাসগুলো ধরে মনে ছিলো উত্তেজনার ঢেউ, অনলাইন ফোরামগুলোতে অচেনা মানুষজনদের সাথে করেছি কত্তোসব অর্থহীন বাকবিতণ্ডা, তা-ও যেনো এখন আর কোনোরূপ উদ্দীপনা ছড়ায় না। এ কেমন অপার্থিব নির্লিপ্ততা…সমস্ত ভালোলাগা, ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতির শিরদাঁড়া অবশ করে দেয়!
অরু এই দিনগুলোকে জমা করে রাখতো হাজার বর্গমাইল দূরের কোনো ভিনদেশি দিশা হারানো ভ্রান্ত দার্শনিকের স্বপ্নদর্শন বলে। এলিয়েনেশনের মহাকাব্যিক মঞ্চ। নীৎশে হয়তো ঠিকই বলেছিলেন, “যে শূন্যে তাকায়, শূন্যও তাকায় তার পানে।” আমিও কি সেই শূন্যতার সুরের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাচ্ছি? তবুও, এতো এতো সংশয়, প্রশ্নবাণের পরে, ‘ও’ একটা খটকা নিয়ে আসে, বসে; আর আমি এহেন নির্জন, দ্ব্যার্থবোধক, অদৃশ্য কিংবা নৈরাশার হবো হবো হিমের সুরাহাহীন তুলসী তলার সন্ধ্যাগুলোতে খুঁজে পাই অদ্ভুত ধরণের আরাম। যেন এই শূন্যতাই আমার পরিচয়, আমার সঙ্গীত, আমার একান্ত সুর।
নিশীথ রাতে, পৃথিবীর সমস্ত শব্দ যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, থেমে যায় সমস্ত সুর, নিজেকে হারিয়ে ফেলি মন কেমনের অন্তহীন প্রবাহে। ভ্রান্তি লাগে, আমি যেন এক আজন্ম জাতিস্মর। অতীতের এক অন্যরূপে ফিরে আসা আত্মা। মনে উড়ে বেড়ায় মেলানকোলিক হিমেল-বাসিত অদৃশ্য ভিনগ্রহী সুর। তৈরি করে অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝে আঁধারের ঘনঘটায় এক নিষিদ্ধ অবগাহনপথ।
উত্তরের জানলা খুলে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা হিমেল বাতাস গায়ে মেখে ভাবতে বসি, কে ছিলাম আমি? সেই অচেনা গ্রামে, পরিত্যক্ত নদীর ধারে, রণক্ষেত্রে, রৌদ্রছায়া ভেজা পথে। আমি কি কোনো যোদ্ধা ছিলাম, নাকি প্রশান্তের অতলে সময় ঘড়িতে নাই হয়ে যাওয়া হালভেঙে দিশা হারানো ওই ভ্রান্ত নাবিক? হয়তো এক বাউন্ডুলে কবি ছিলাম।
তুমি কি জানো, আমরা একে অপরকে কতবার পেয়েছি, হারিয়েছি, আবার খুঁজেছি, খুঁজে পেয়েছি? হয়তো শতক পাঁচেক আগে পাশ্তুনের স্বপ্নীল অলস দুপুরে ছোট্টো জলপাইবাগানের মধ্যিখানে বাড়িটায়, যেখানে তুমি ছিলে মহামায়া অরুন্ধতী, আর আমি হয়তো সেই মায়াভ্রমক আদাবে-ইয়ার। হয়তো হাজার দেড়েক বছর আগে আমরা ছিলাম দু’টি অশ্রুমতি নদী, যারা এক হয়ে মিশেছিল সমুদ্রের বুকে। কিংবা ছিলাম অতল প্যাসিফিকে একই সুরে সাঁতরে বেড়ানো একজোড়া নীল তিমি।
পাশের গ্রামোফোন থেকে বেজে উঠে তোমাকে সবসময় বলতে না পারা কিছু শব্দ,
আজ বার্গ-এ গুল কাগাজ সাযাম
নামা-এ শিরিন বে পারদাজাম
বেনাবিসাম আজ এশ্কম, রাজাম
আই নও গুল-এ মান
সুলতান-এ কালবাম তু হাস্তি, তু হাস্তি
দারওয়াজা হায়-এ দিলাম রা শেকাস্তি
পেইমান ইয়ার-এ তু বার মান বেবাস্তি
চাশ্ম-এ ইনতেজারাম
এ অনুভূতির নাম জানি না। এ ভিনদেশী অনুভূতি, আমার কোনো কিছু ভালো লাগে না, আবার সব ভালো লাগে — এই দুইয়ের মাঝে চিরকালীন দ্বন্দ্ব। তবুও, এ দিনগুলো ফিরে আসুক। জানিয়ে দিক। নিয়ম করে বসাক শূন্যের সন্তান জাতিস্মর হবার সনদ নিয়ে। তাসওয়াফে। আর শেষ হোক, অপমিত পৌনঃপুনিকতায়।
জন্মাবধি জন্মলগ্নের মায়াভ্রমে মোড়ানো আজন্ম মায়াভ্রমক আমার আবারও ইচ্ছে স্বাধীন ভ্রমে ডুববার স্বাদ জাগে। মুহূর্তেই মহাশুণ্যে হারিয়ে নিমেষেই নিজের সোলকে আবিষ্কার করি ভিনগ্রহের অচীন দেশেতে। সে দেশ জীবনানন্দের মায়াবী পারের দেশের মতোই স্নিগ্ধ। বা মায়া ছড়ায় তাঁরচে একটু বেশি। আপেল গাছের ছায়ায় শায়িত আমার অমৃতসন্ধানী দিব্য প্রেমিকার শেষ উপহার ভায়োলিনে অশ্রুনীল সুর-তরঙ্গ মাফিক পথ ধরি মায়াবী নদীর পানে। এ দেশেতে মায়াবী পারের দেশটির মতো করে চাপিয়ে দেওয়া কোনো নিয়মই ঠিক সুবিধে করতে পারে না। এখানে অচীনদেশের অজানি আইনে সব সময়ের জন্যে পালা করে বাসা বেঁধে বিরাজ করে বসন্ত কিংবা শরত। নদীর প্রাণে হামাগুড়ি দেয় মায়ের জঠর থেকে সদ্য আবির্ভূত আদম-সন্তান। প্রজাপতিদের সঙ্গে একটু জিরিয়ে নেবার শ্বাস সমেত বসানো যায় ডেড পয়েট সোসাইটির আসর। আসর শেষে নির্বাণাবাসী অরু গ্রীক মিথলজির দেশ থেকে সদ্য টেলিপোর্ট হওয়া মিষ্টকন্ঠী এউডা রুপে তাঁর বাঁশি-বীণায় সুর ধরে তাল মেলায় আমার সঙ্গে।
শুনতে বসি রাশিয়ান ধ্রুপদী সঙ্গীত ‘অচিরন্তন সুর’। আমাদের দস্তয়েভস্কির সাদা রাতের মায়ায় ভেজা নিজের অদৃশ্য গল্পের মতোই পরিণতিহীন। একেকটি বাঁধা-বিঘ্নিত নোট, কখনো পূর্ণ হয় না, কখনো গতি পায় না। বিরাগিত সুরে; আলো এবং অন্ধকারের মাঝে কোথাও।
মোহমুগ্ধা, যাদুবশীভূতা,
ভ্রমে দেখি রাতের চাঁদের আলোয় ঢাকা,
ঝড়ে ভাঙা গাছের শাখা,
পথ হারানো নদীর ধারা
নদীর কূলে ঘেরা কেবল তুমি, শুধু তুমিই রও
তোমার রঙিন আভা,
অন্ধকারের কুয়াশায় ঢাকা,
তুমি এমন স্বপ্নের সোনালি ছটা আলো,
বলতে চাই কোনো স্বপ্নের কুহক দেখা
নভেম্বার রেইনের আহ্লাদে ঝিলাম নদীর দেশের অলীক পাহাড়ের ওপাশে তখন রাত্তির নেমে আসে। হিম জড়ানো নিঃসঙ্গতার হবো হবো সন্ধ্যায় বব ডিলান কিংবা লিওনার্দ কোহেনের বিষণ্ণ-বিরাগের আবহ শব্দে পথিক কালের অর্থবহতা উপলব্ধি মাত্রই হয়তো আমরা আবার এসে পৌঁছাই আমাদের আসল সুরে, সংশয়ভেজা অনিকেত প্রান্তরে অপমিত পৌনঃপুনিকতায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন