পড়ছি; হুমায়ূন আহমেদ

কাফকা-নিৎসে থেকে শুরু করে মার্‌কেজ-মুরাকামিসহ দেশ-বিদেশী শ’য়ের কাছাকাছি নানান ধারার লেখকদের নানান ধরনের লেখা, সব মিলিয়ে শ’পাঁচেক বই পড়বার পর রিয়েলাইজেশান হচ্ছে, আমার সবচে প্রিয় লেখক আসলে হুমায়ূন আহমেদ। আমার কম্ফোর্‌ট জোন। ব্যপারটা স্বাভাবিক লাগলেও আমার কাছে আসলে ততোটাও স্বাভাবিক না। ব্যপারটা আসলে আমার কাছে অনেকটা নিজের রুটে ফেরবার মতো।

মনে পড়ে আমার প্রথম হুমায়ূন আহমেদ পড়ার কথা। ক্লাস থ্রি-র একটা বাচ্চা বড়ো কারো থেকে লুকিয়ে এনে পড়ছে ‘মিসির আলি! আপনি কোথায়?’ এর আগে যার দৌড় ছিলো কেবল লোকাল কিছু কমিক্স-ম্যাগাজিন বা নাম না জানা বিভিন্ন শিশু সাহিত্য পর্যন্ত। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমার প্রথম অনুভূতি খুব একটা যে ইতিবাচক ছিলো, তাও বলা যায় না। তাঁকে নিয়ে আমার প্রথম ভাবনাটা ছিলো, ‘গল্প ভালো। কিন্তু লোকটা কত অশ্লীল!’ (ওই নভেলাটা যারা পড়েছেন, বুঝতেসেন কীসের কথা বলছি।) তাও কীভাবে আমি হুমায়ূন আহমেদের দিকে ঝুঁকে গেলাম সেটাও খানিকটা ডিবেটের বিষয়।

এরপর কেটে গেছে অনেক সময়। বাচ্চাটাও বড়ো হতে লাগলো। তার সাথে বাড়তে থাকলো পড়া বইয়ের সংখ্যাও। যার বেশির ভাগ জুড়েই থাকতো হুমায়ূন আহমেদ-জাফর ইকবাল বা শীর্ষেন্দু মুখার্‌জি-সুনীল গাঙ্গুলি। বা বিসাকের অচেনা কিছু ফরেইন রাইটারদের ট্রান্সলেশান। সে-ই সাথে এভারেজ বাঙালি পাঠক হিসেবে আবশ্যিকভাবে রবীঠাকুর, শরৎচন্দ্র-বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কররাতো আছেনই। হ্যাঁ, সবার মতো আর্লি লাইফে তিগো বা মাসুদ রানা আমার খুব বেশি পড়া হয়নি।

মাঝে আবার কোভিডের বেশ অনেকটা সময়টা বইটই পড়া হচ্ছিলো না বললেই চলে। মুভি-সিরিজ আর ব্লগিংট্‌লগিং-র ঝোঁক আসা নিয়ে কেটে যায়। ওই সময়টাতে আমি আমার সবরকম কমিউনিটি ছেড়ে আইসোলেটেড হয়ে পড়েছিলাম অনলাইন-অফলাইনে। নতুন কিছু এক্সপেরিয়েন্স করতে চাচ্ছিলাম। বাজে ফেইজ বললেও ভুল হবে না। দ্যান সে বছরের শেষ দিকে কীভাবে যেনো পড়ার অভ্যেসটা আবার আসতে শুরু করে।

এর মাঝে বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে ভালো ভাবে পড়াশুনো শুরু হয়। আরো রিচ কালেকশান নিয়ে, অজানা কত্তসব লিট টার্মসের ওভারভিউ নলেজ নিয়ে পড়া হতে থাকে বিশ্ব সাহিত্যের নামীদামী কতো লেখকদের লেখা! দেশের কতো চেনা থেকেও অচেনা লেখকদের নানান লেখা নতুন চোখে আবিষ্কার করতে থাকি। শহীদুল জহির-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শাহাদুজ্জামানদের মতো লেখকদের লেখার সাথে পরিচয় হতে থাকে। যারা পরবর্তীতে আমার প্রিয় লেখকদের তালিকায় চলে আসেন।

আগে বিসাক বা পাব্লিক লাইব্রেরীর কল্যাণে বিচ্ছিন্ন ভাবে তাঁদের অনেক লেখা পড়া হলেও; একটা থাকে না যে জেনেশুনে, থট এনালাইজিং করবার মতো ভাবনা নিয়ে পড়া, তখন বয়সের কারণে হোক অন্য কোনো কারণেই হোক, ওটা ছিলো না। বিসাকের কথাই ধরা যাক, ও সময়ে কতো মাস্টারপিস পড়িয়ে নিয়েছে। ওই লেখাগুলোর ওয়েট যে কতটুকু তা পরবর্তীতে বড়ো হয়ে রিয়েলাইজ করেছি। অথচ শুরু করেছিলাম রেন্ডম কিছু ভেবে, অপশনের অভাবে।

পড়া বইয়ের সংখ্যার দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ সবার উপরে থাকলেও, বলতে দ্বিধা নেই বেশ অনেকটা সময় ওরকম ‘হুমায়ূন আহমেদের আবার সাহিত্য হলো নাকি! ও-তো বাজারি লেখক। গভীরতা নাই।’ বলা আঁতেলগোত্রীয় ব্রাদারদের সাথে কিছুটা সহমত প্রকাশ করে চলতাম। প্রকাশকদের চাপগোত্রীয় অন্যান্য কারণে বের হওয়া তাঁর বাজে লেখা নেই, তা বলবো না। অবশ্যই আছে। সেটা অন্য ডিবেট। ওরকম করা যে দোষ তা-ও বলবো না। তবে অনেকগুলো কাজে তাঁর লেখনশৈলী যে কোয়াইট এনালিটিক, থট প্রভকিং, ওয়েল স্ট্রাকচারড – অনেক পরে তা আস্তে আস্তে রিয়েলাইজ করছি।

যে গল্পগুলো আমার কাছে চেনা থেকেও অচেনা। নতুন খামে পুরনো চিঠি। সামনে এরকম কিছু কাজ নিয়ে নিজের অতিসীমাবদ্ধ জ্ঞান থেকে আলোচনা করবার আশা রাখছি। সময় যাচ্ছে, বড়ো হচ্ছি, নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করছি। পড়ছি, জানছি। এইতো। এসব হাই-থট কন্টেন্ট কনজিউমের ভিড়ে সম্ভবত সব সময়ের জন্য আমার বড়ো করে দম নেবার জায়গা হয়ে থাকবে হুমায়ূন আহমেদ, বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র।

.

২২ – ০৮ – ২০২৩

মন্তব্যসমূহ